আপনি কি জানেন যে পবিত্র আশুরা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় দিন নয়, বরং এটি ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিনগুলোর একটি? হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মুহাররম এর ১০ তারিখে পালিত এই দিনটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, সেটাই আজকে আমরা জানবো।
মনে করুন, আপনি একটি সময় যন্ত্রে করে ১৪০০ বছর পিছনে চলে গেছেন। কারবালার উত্তপ্ত বালুকাময় প্রান্তরে দেখতে পাচ্ছেন একটি অসম যুদ্ধ। একদিকে মাত্র ৭২ জন বীর যোদ্ধা, অন্যদিকে হাজার হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী। এই যুদ্ধের কেন্দ্রে রয়েছেন নবীজির দৌহিত্র ইমাম হোসেন (রা.)।
আশুরা কী এবং কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ?
আশুরা শব্দটি আরবি “আশারা” থেকে এসেছে, যার অর্থ “দশ”। এটি হিজরি ১০ মুহাররম তারিখে পালিত হয়। কিন্তু এই দিনের গুরুত্ব কেবল একটি সংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
আমি যখন প্রথম কারবালার যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারি, তখন আমার মনে হয়েছিল এটা যেন কোনো মহাকাব্যের গল্প। কিন্তু না, এটা সত্যিকারের ইতিহাস। ৬৮০ সালের ১০ অক্টোবর (হিজরি ৬১ সনের ১০ মুহাররম) এই দিনে ইমাম হোসেন (রা.) ও তার ৭২ জন সহযোগী উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদের বিশাল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে শহীদ হন।
মুহাররম মাসের বিশেষত্ব
মুহাররম মাস হচ্ছে ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং চারটি সম্মানিত মাসের একটি। রাসূল (সা.) এটিকে “আল্লাহর মাস” বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই মাসের পবিত্রতা কতটা গভীর, তা বোঝা যায় এই কথা থেকে যে আল্লাহ তায়ালা নিজেই এই মাসগুলোকে সম্মানিত করেছেন।
[এখানে একটি সুন্দর ইসলামিক ক্যালেন্ডারের ছবি যুক্ত করুন যেখানে মুহাররম মাস হাইলাইট করা থাকবে]
আশুরার দিনের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী
আপনি জানলে অবাক হবেন যে আশুরার দিনে শুধু কারবালার যুদ্ধই হয়নি, বরং আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে:
- আল্লাহ তায়ালা আকাশ-জমিন সৃষ্টি করেন
- হজরত আদম (আ.) পৃথিবীতে আগমন করেন
- হজরত নূহের (আ.) জাহাজ জুদি পাহাড়ে স্থির হয়
- হজরত ইবরাহিম (আ.) নমরুদের আগুন থেকে মুক্তি পান
- হজরত মুসা (আ.) ফেরাউনের অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ লাভ করেন
এই তালিকা দেখে মনে হয় না যে এই দিনটি কোনো সাধারণ দিন? এটা যেন আল্লাহর বিশেষ রহমত ও করুণার দিন।
আশুরার রোজা: ফজিলত ও নিয়মাবলী
রোজার অসাধারণ ফজিলত
আশুরার রোজার ব্যাপারে রাসূল (সা.) এর বাণী শুনলে আপনার হৃদয় কেঁপে উঠবে। তিনি বলেছেন, “আল্লাহর কাছে আশা করি তিনি আশুরার রোজার মাধ্যমে বিগত এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।”
ভাবুন তো, মাত্র একটি রোজার বিনিময়ে পূর্ণ এক বছরের গুনাহ মাফ! এটা আল্লাহর কতটা বড় দয়া।
কত দিন রোজা রাখবেন?
এখানে একটি চমৎকার বিষয় আছে। আশুরার রোজা শুধু ১০ তারিখে একটি রাখা যায়, কিন্তু রাসূল (সা.) আরো ভালো একটি উপায় বলে দিয়েছেন:
রোজার ধরন | তারিখ | ফজিলত |
---|---|---|
একক রোজা | ১০ মুহাররম | ভালো |
দ্বিতীয় পছন্দ | ১০ ও ১১ মুহাররম | আরো ভালো |
সর্বোত্তম | ৯ ও ১০ মুহাররম | সবচেয়ে উত্তম |
কেন ৯ তারিখ রাখা উত্তম? রাসূল (সা.) বলেছেন, “আগামী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা ৯ তারিখের সাথে ১০ তারিখ মিলিয়ে দুই দিন রোজা পালন করব।” এটি ইহুদিদের সাথে পার্থক্য সৃষ্টির জন্য।
[এখানে একটি রোজার সময়সূচীর টেবিল বা ইনফোগ্রাফিক যুক্ত করুন]
কারবালার মর্মস্পর্শী ইতিহাস
আমি যখনই কারবালার ইতিহাস পড়ি, তখন আমার চোখে পানি চলে আসে। এটা শুধু একটা যুদ্ধ নয়, এটা সত্য আর মিথ্যার, ন্যায় আর অন্যায়ের চূড়ান্ত লড়াই।
যুদ্ধের পটভূমি
উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ যখন ইমাম হোসেন (রা.) এর কাছে বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) দাবি করলো, তখন তিনি সেটা প্রত্যাখ্যান করলেন। কারণ? ইয়াজিদের চরিত্র ও আচরণ ইসলামের শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক ছিল।
অসম যুদ্ধ
কুফাবাসীদের আমন্ত্রণে ইমাম হোসেন (রা.) কুফার উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু কারবালায় পৌঁছে তিনি দেখেন সম্পূর্ণ অন্য চিত্র। তার সাথে ছিল মাত্র ৭২ জন, আর বিপক্ষে হাজার হাজার সৈন্য।
শিয়া ও সুন্নিদের আশুরা পালন
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা দরকার। শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে আশুরা পালনের পদ্ধতি ভিন্ন:
সুন্নিদের পালন:
- আশুরার দিনে রোজা রাখা
- হজরত মুসা (আ.)-এর মুক্তির দিন হিসেবে পালন
- দোয়া ও জিকিরে মশগুল থাকা
শিয়াদের পালন:
- ইমাম হোসেন (রা.)-এর শাহাদতের শোকে পালন
- তাজিয়া মিছিল বের করা
- মাতম ও শোক প্রকাশ
মুহাররম মাসের আমল ও করণীয়
যা করা উচিত:
- নফল রোজা রাখা – বিশেষ করে আশুরার রোজা
- বেশি বেশি জিকির করা – আল্লাহর স্মরণে মগ্ন থাকা
- কুরআন তিলাওয়াত – বেশি করে কুরআন পড়া
- দান-সদকা – গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করা
- তওবা-ইস্তিগফার – অতীতের গুনাহের জন্য অনুতপ্ত হওয়া
যা এড়িয়ে চলা উচিত:
মুহাররম সম্মানিত মাস হওয়ায় এই মাসে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে:
- ঝগড়া-বিবাদ থেকে দূরে থাকা
- অন্যায়-অত্যাচার না করা
- গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকা
- অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা কম বলা
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, “এই মাসগুলিতে তোমরা পরস্পরের উপরে অত্যাচার করো না।”
আশুরার দিনের বিশেষ খাবার ও আয়োজন
ঐতিহ্যবাহী খাবার
বাংলাদেশে আশুরার দিনে বিশেষ কিছু খাবারের ব্যবস্থা করা হয়:
জনপ্রিয় খাবার:
- আশুরার খিচুড়ি – পোলাও চাল ও মিশ্র সবজি দিয়ে
- বিশেষ মাংসের পদ – আলুবোখারা সহ ঝাল মুরগি
- মিষ্টি জাতীয় – খেজুর, বাদাম, মধু
- পুষ্টিকর খাবার – দুধ, ফল, শুকনো ফল
হাদিসের আলোকে খাবারের বিধান
হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে আছে যে, আশুরার দিন পরিবার-পরিজনের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করলে আল্লাহ পূর্ণ বছর স্বচ্ছলতা দান করবেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই হাদিসটি জঈফ বা দুর্বল।
তাই আমার পরামর্শ হলো, খাবারের আয়োজন করুন আনন্দের সাথে, কিন্তু এটাকে বাধ্যতামূলক ভাববেন না।
[এখানে বাংলাদেশি ঐতিহ্যবাহী আশুরার খাবারের ছবি যুক্ত করুন]
আশুরা থেকে আমাদের শিক্ষা
সত্যের জন্য লড়াই
ইমাম হোসেন (রা.) এর জীবন থেকে আমরা শিখি যে সত্যের জন্য লড়াই করতে হয়, যতই কঠিন হোক না কেন। তিনি জানতেন যে এই যুদ্ধে জেতার সম্ভাবনা কম, তবুও তিনি আপোস করেননি।
ধৈর্য ও সবর
কারবালায় পানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তিন দিন পানি পান করতে পারেননি ইমাম হোসেন (রা.) ও তার সাথীরা। কিন্তু তারপরও তারা ধৈর্য হারাননি।
আল্লাহর উপর ভরসা
সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তেও ইমাম হোসেন (রা.) আল্লাহর উপর ভরসা রেখেছিলেন। এটাই আমাদের জীবনের মূল শিক্ষা।
আধুনিক যুগে আশুরার প্রাসঙ্গিকতা
আজকের যুগেও পবিত্র আশুরার শিক্ষা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমরা যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ভয় পাই, তখন ইমাম হোসেন (রা.) এর আদর্শ আমাদের সাহস দেয়।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে
- অফিসে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা
- পরিবারে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা
- সমাজে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা
- নিজের মধ্যে সততা বজায় রাখা
এসবই কারবালার শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগ।
সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
আশুরার রোজা কি বাধ্যতামূলক?
না, আশুরার রোজা বাধ্যতামূলক নয়। এটি নফল বা সুন্নত রোজা। তবে এর ফজিলত অনেক বেশি।
গর্ভবতী মহিলারা কি আশুরার রোজা রাখতে পারবেন?
গর্ভবতী মহিলারা যদি সুস্থ থাকেন এবং রোজা রাখতে কোনো সমস্যা না হয়, তাহলে রাখতে পারবেন। তবে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া ভালো।
আশুরার দিনে কি কোনো বিশেষ দোয়া আছে?
বিশেষ কোনো নির্দিষ্ট দোয়া নেই। তবে বেশি বেশি তওবা-ইস্তিগফার, জিকির-আজকার করা উত্তম।
শেষ কথা: আশুরার আলোকে আমাদের জীবন গড়ি
পবিত্র আশুরা শুধু একটি ধর্মীয় দিন নয়, এটি আমাদের জীবনের দিকনির্দেশনা। ইমাম হোসেন (রা.) এর আদর্শ অনুসরণ করে আমরা আমাদের জীবনকে আরো সুন্দর ও অর্থপূর্ণ করে তুলতে পারি।
এই মুহাররম মাসে আসুন আমরা সবাই:
- আল্লাহর কাছে বেশি বেশি তওবা করি
- আশুরার রোজা রেখে সওয়াব অর্জন করি
- দান-সদকা করে দরিদ্রদের পাশে দাঁড়াই
- সত্যের পথে অটল থাকার অঙ্গীকার করি
আপনার কি মনে হয় আশুরার শিক্ষা আমাদের বর্তমান জীবনে কতটা প্রয়োজনীয়? নিচে কমেন্টে আপনার মতামত জানান। আর এই লেখাটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে, তাহলে আপনার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে চলার তওফিক দান করুন। আমিন।
প্রয়োজনীয় বই ও রিসোর্স:
- মুহাররম ও আশুরার ফযিলত – মুহাম্মাদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ
- আশুরার ফযীলত ও মুহাররম মাসে করণীয়-বর্জনীয় – শাইখ আব্দুল আযীয বিন বায (রহ.)
- কারবালা – সাহাদত হোসেন খান
উৎস ও তথ্যসূত্র: এই লেখায় ব্যবহৃত সকল তথ্য নির্ভরযোগ্য ইসলামি সূত্র ও প্রামাণিক হাদিস গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত।
I’m currently studying Journalism at Jahangirnagar University. Alongside my academic journey, I’ve also been involved in freelancing, which has helped me gain practical experience and broaden my skills. In my free time, I love reading books — it’s both a passion and a source of inspiration for me.